ফারহানা পারভীন
বিবিসি বাংলা, ঢাকা
বাংলাদেশে ঈদের কেনাকাটায় যোগ হয়েছে নতুন বাজার -- অনলাইনে কেনাকাটা।
বিভিন্ন জায়গা ঘুরে, যাচাই করে কেনাকাটার যে চল ছিল এখনো সেটা রয়েছে। সাথে যোগ হয়েছে ইন্টারনেটভিত্তিক এই শপিং। জামা, কাপড়, জুতা থেকে শুরু করে টুপি, আতর, জায়নামাজ সবই কেনাবেচা হচ্ছে এখানে।
মেয়েকে সাথে নিয়ে ঈদের শাড়ি দেখছেন তাহমিনা হক। তবে সেই শাড়ি দোকানে বসে দেখছেন না, দেখছেন নিজের বাসার কম্পিউটারে। ইন্টারনেটে কাপড় কেনার একটি সাইট থেকে তারা কাপড়ের রং, ধরন ও দাম যাচাই করছেন।
মিসেস হকের কাছে জানতে চেয়েছিলাম তিনি কেন অনলাইনে কেনাকাটার কথা চিন্তা করছেন? তিনি জানালেন, ব্যস্ততার কারণে শপিং করার খুব একটা সময় হয়ে ওঠে না। যানজট আর ভীড় ঠেলে মার্কেটে যেতেও ইচ্ছা করে না। তাই অনলাইনে শপিং করা তার জন্য সবচেয়ে সহজ। তিনি অনলাইনে যে কোন প্রডাক্ট কেনেন। ওয়েবসাইটগুলোতে যে ফোন নম্বর দেওয়া থাকে সেখানে তাদের সাথে কথা বলে পণ্য সম্পর্কে আরও বিস্তারিত ধারণা নেন। অর্ডার দেন। আর কোন ঝামেলা ছাড়াই তার বাসায় পৌঁছে যায় পছন্দের জিনিসটি।
বাংলাদেশে বেশ কয়েক বছর ধরেই অনলাইনে কেনাকাটার আগ্রহ বাড়ছে মানুষের মাঝে। কর্মব্যস্ততার কারণে রাস্তার যানজট ঠেলে, দোকানে গিয়ে কেনাটাকে তাই অনেকেই এখন সময়ের অপচয় বলে মনে করছেন। ঢাকায় থাকেন শহীদুল ইসলাম। তিনি বললেন, ঈদের কেনাকাটায় এবারে শাড়ীগুলো তিনি কিনেছেন অনলাইনে। আর বাসায় বসে অনলাইনে এসব কাপড় পরিবারের সবার পছন্দেই কেনা হয়েছে।
ইন্টারনেটে এখন বাংলাদেশের বিভিন্ন ওয়েবসাইটে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পাওয়া যাচ্ছে। এমনি একটি ওয়েবসাইট এখনি.কম।
ওয়েবসাইটটির মূত পাতায় গেলে দেখা যায় এখানে তারা নিজেদের তৈরি পণ্য বিক্রি করেন না। অন্যদের তৈরি পোশাক, ঘড়ি, চশমা, জুতা, আতর, টুপি, জায়নামাজসহ নানা পণ্যের ছবি রয়েছে সেখানে। পাশে দাম এবং পণ্যের বিবরণ। একটি ফোন নম্বর দেয়া আছে। চাইলে অনলাইনেও অর্ডার দিতে পারেন আবার ফোন করেও কিনতে পারেন। এই অনলাইন শপের মালিক শামীম আহসান বলছিলেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশে এভাবে কেনাকাটার ধারণা থাকলেও আমাদের দেশে ছিল না। তাই বাংলাদেশের পণ্য দেশ ও বিদেশের মানুষের কাছে পৌঁছে দিতেই তারা এই ওয়েবসাইট চালু করেন।
তিনি জানালেন, এবারে ঈদের সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে মেয়েদের সালোয়ার কামিজ আর ছেলেদের পাঞ্জাবি। এছাড়া টিশার্ট, আতর, টুপি, ও খেজুর। আর গত ঈদের চেয়ে এবারে কেনাবেচা দ্বিগুণ হচ্ছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
বাংলাদেশে এখন এধরনের ওয়েবসাইটের বাইরেও সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট ফেসবুকে বিভিন্ন পেজ খুলেও বেচাকেনা হচ্ছে বিভিন্ন জিনিসের। ফেসবুকে এমন একটি পেজের নাম স্টাইল ওয়ার্ল্ড কালেকশন। পেজটিতে যেয়ে দেখা তখন পর্যন্ত পাঁচ লক্ষ ৭৫০০ লাইক রয়েছে। সেখানে মেয়েদের পোশাক ছাড়াও পাওয়া যায় ছেলেদের পোশাকও। এই একি নামে গুলশানের একটি শপিং মলে তাদের দোকান রয়েছে। স্টাইল ওয়ার্ল্ডের মালিক মিস পলি বললেন, ২০০৫ সাল থেকে তিনি ঐ শপিংমলে দোকান দিয়েছেন। বেচাকেনা খুব একটা খারাপ ছিল না। তবে গত দুবছর হল তিনি ফেসবুকে একটি পেজ খুলো তার দোকানের সব পণ্যের ছবি আপলোড করাতে বিক্রি বেড়েছে কয়েকগুণ।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস বেসিস-এর সভাপতি ফাহিম মাশরুর জানান, অনলাইনে সবচেয়ে বড় সুবিধা ক্রেতারা যেটা পাচ্ছেন, সেটা হল ঘরে বসে অর্ডার দিয়ে ঘরে বসেই পেয়ে যাচ্ছেন। আর অনেক ক্ষেত্রে এই দাম শপিংমলের দামের থেকেও কম থাকায় ক্রেতারাও আগ্রহী হয়ে উঠছেন।
এক্ষেত্রে ১০০০ টাকার নিচে যেসব পণ্য রয়েছে সেসব পণ্য মানুষ বেশি কিনছে বলে তিনি জানান। প্রথমে এটি রাজধানী ঢাকা-কেন্দ্রিক থাকলেও এখন বড় বড় শহরের মানুষও ইন্টারনেটে কেনাকাটায় আগ্রহী হচ্ছেন। মি. মাসরুর বলেন, এবারে ঈদ উপলক্ষে ইন্টারনেটে প্রতিদিন তিন থেকে পাঁচ কোটি টাকার কেনাবেচা হচ্ছে বলে তারা হিসেব পাচ্ছেন।
অনলাইনে কেনাকাটার আরেকটি সাইট বাংলাদেশ ব্রান্ডস-এর ধানমন্ডি অফিসে গিয়ে দেখা গেল একটি এপার্টমেন্টে দুই কামরার একটি রুমে অফিসের কাজ চলছে। সেখানে তিনজন কর্মী কম্পিউটারের সামনে ওয়েবসাইটের দিকে নজর রাখছেন । সেখানে তারা প্রতিনিয়ত খেয়াল রাখছেন তাদের ওয়েবসাইটে ক্রেতারা কোন কোন পণ্যের অর্ডার দিচ্ছেন। সেগুলোর একটা তালিকা তৈরি করছেন। অফিসের আরেকটি রুমে ক্রেতাদের অর্ডাকৃত পণ্য ডেলিভারি জন্য প্যাকেট করছেন কিছু কর্মী।
সেখানে আমার কথা হচ্ছিল বাংলাদেশ ব্রান্ডস-এর মালিক সাদিকা হাসানের সাথে। তিনি জানান তার মূল ক্রেতা ঢাকার বাইরে বিভিন্ন শহরের মানুষ আর বাংলাদেশের বাইরে প্রবাসী বাংলাদেশিরা।
অনলাইনে কেনাকাটায় যেমন আগ্রহ বাড়ছে মানুষের তেমনি এখানে কেনাকেটা নিয়ে কিছুটা অসন্তোষও রয়েছে কোন কোন ক্রেতার মনে। আমি গুলশানের একটি শপিংমলে গিয়েছিলাম সেখানে বেশ কয়েকজন ক্রেতার সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল। শ্যামলীন মেহরিন হক বললেন, অনলাইনে তিনি একবার একটি লাল কাপড়ের অর্ডার দেন ওয়েবসাইটে দেয়া ছবি দেখে। কিন্তু কাপড়টি যখন তার বাসায় এল, তখন দেখা গেল সেটা কমলা রংয়ের। তাই তিনি মার্কেটে এসে নিজে পরখ করে কাপড় কিনতে চান।
এক রকম জিনিস চেয়ে অন্য রকম জিনিস পাওয়ার কথা যেমন শোনা যায় অনেকের কাছে, আবার বাসায় পণ্য ডেলিভারি নিয়ে বিড়ম্ববনার কথা বললেন অনেকেই। গুলসানের বাসিন্দা মি.ওসমান বললেন, জিনিসটা না আসা পর্যন্ত সারাদিন বাসায় বসে অপেক্ষা করতে হয়। এতে সময়ের অপচয় হয়।
আবার অনেকে বলছেন, ঈদের কেনাকাটায় পরিবারের সবার সাথে কেনাকাটা করতে যাওয়ার যে মজা সেটা অনলাইনে পাওয়া যায় না। বারিধারায় থাকেন লিরা। বন্ধুদের সাথে এসেছেন ঈদের কেনাকাটা করতে। তিনি বললেন, ''আমরা সবাই মিলে ঘুরছি, মজা করছি, একজনের পছন্দের সাথে আরেকজন মতামত দিচ্ছি, দামাদামি করছি এটার মজাই আলাদা।''
অনলাইনে অর্ডার করলে পণ্য পৌঁছে যাচ্ছে বাসায়। মূল্য পরিশোধে পাওয়া যাচ্ছে ব্যাংকের সহায়তাও। অনেকেই মোবাইল ফোনের মাধ্যমেই পরিশোধ করছেন মূল্য। ক্যাশ অন ডেলিভারি পদ্ধতিতে বা গ্রাহক পণ্য হাতে পাওয়ার পর দাম মেটানোর সুযোগও রয়েছে। তাই ক্রেডিট কার্ডে কেনার বাধ্যবাধকতা নেই।
বাংলাদেশে এখন তাই অনলাইন বাজারে কেনাকাটা করতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করছেন ক্রেতাদের একটা বড় অংশ।
No comments:
Post a Comment